কলকাতা শহরে পুজোয় নাকি খুব ধূমধাম৷
বাজারের ঠাকুর, হাতিবাগানের ঠাকুর, দমকলের ঠাকুর নামকরা সব ঠাকুর৷ ক’টা দিন খুব ভিড় হয়৷ মেলা বসে৷ আলোয় ভালো হয়ে চারদিক ঝলমল ঝলমল করে৷ মাইক গান বাজে৷ ঢোল বাজ৷
হাতিদাদাকে ডেকে বললুম, “মানুষের দেশে হাতি তো খুব খাতির৷ তুমি যদি আমাকে কলকাতার ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাও তো চ্যাংড়া কুকুরগুলো কী করতে পারে শুনি? চলো না গো, হাতিদাদা, লক্ষ্মীটি৷
হাতিদাদা বলেন,রাজি৷ তবে তোমার ওই খেঁকুরে মার্কা চেহারাটা ঢেকেঢুকে যেতে হবে, বাপু৷ যেন কেউ চিনতে না পারে৷ আদ্দির পাঞ্জাবি গিলে করে গায়ে চাওড়া, ফিনফিনে ধুতি কুঁচিয়ে পরো, টেকো মাথায় চাপাও জরিদার পাগড়ি চোখে দাও চশমা- তারপর দিবি্ও রাজাবাবুটি হয়ে বাগিয়ে বসে পড়ো আমার পিঠের ওপর৷
হাতিদাদার বুদ্ধি ভারী খাসা৷ কত বড়ো মাথাটা বুদ্ধিতে ঠাসা একেবারে৷ যেমনটি বলেছে ঠিক তেমনিটি সেজে নিয়েছে৷ নিয়ে দুগ্গা বলে উঠে বসেছি তার পিঠে৷ কিন্তু হাতিদাদা বজ্জ আস্তে আস্তে হাঁটে৷ আর ডাইনে বাঁয়ে শুঁড় চালিয়ে মটমট করে ডালপালা ভাঙে৷
আমি তাড়া দিই ও হাতিদাদা, তাড়াতাড়ি চলে না গো, পুজো যে ফুরিযে যাবে?
হাতিদাদা বলে, "ব্যস্ত কেন, আর তো মোটে একপোয়া পথ৷ ওই শোন- ঢাকের বা্দ্যি কানে আসছে৷
তা হাতিদাদা মিথে বলেনি৷ ঢাকের বা্দ্যি সত্যিইি কানে আসছে৷ ক্রমেই যেন কাছে আরও কাছে এগিয়ে আসছে৷
এই করে তো একসময় পে্ৗঁছে গেছি কলকাতায়৷ রাত তখন ভোর হচ্ছে৷ লোকেরা গঙ্গায় চান করতে যাচ্ছে৷ কত লোক সারারাত ঠাকুর দেখে দেখে এখন হইচই করে বাড়ি ফিরছে৷
তারপর একটু বেলা হতেই তো আমার মাথা ঘুরে যায়৷
বাপ রে বাপ! এই নাকি কলকাতা৷
কী পেল্লায় পেল্লায় সব বাড়ি৷ কোনটা চারতলা, কোনটা পাঁচতলা, কোনটা সাততলা - একের পর এক আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর গিজগিজ গাড়ি ঘড়ঘড় রাস্তাগুলোর তো চলা দায়, ট্রাম, বাস, টেমপো, লরি, রিক্সা, ঠেলা... কতরকম গাড়ি৷ প্যাকপ্যাক ঠংঠং ঠুংঠুং কতরকম আওয়াজ৷
এখন হাতিদাদাকে নিয়েই ভারী মুশকিল৷ এই গাড়িঘোড়ার ভিড়ে একটা মশা গলবার জায়গা নেই তো হাতি কেমন করে? তা ছাড়া লোকে রাস্তায় হাতি দেখতে পেয়ে ঠাকুর দেখতেই ভুলে যাচ্ছে৷ হাতিদাদাকে ঘিরে ভিড় জমে উঠছে৷ বাচ্চাগুলোর তো খুব ফুর্তি কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে ডাবের খোলা, কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে পয়সা
এমন সময় দেখা গেল- ঢাক বাজিয়ে কারা কলাবউকে চান করিয়ে ফিরছে৷ হাতিদাদা আবার কলাগাছ খেতে বড্ড ভালোবাসে৷ লোভ সামলাতে না পেরে দিয়েছে তো শুঁড় বাড়িয়ে কলাবউকে খাবে বলে৷ পুরুতমশাইও বাবা রে মা রে বলে কলাবউকে জাপটে ধরেই দিয়েছে এক তিড়িং লাফ৷ সঙ্গে সঙ্গে সে এক হইহই ব্যাপার রইরই কান্ড৷ হাতি খেপেছে মনে করে যে যেদিকে পেরেছে ছুটেছে৷
বাস, গাড়ি_ঘোড়া বন্ধ৷ ট্রাফিক জ্যাম৷
রাস্তার পুলিশ ঘন ঘন বাঁশি বাজাচ্ছে আর ছুটোছুটি করছে৷
ট্রামের পর বাস, বাসের পর ট্যাক্সি, ট্যাক্সিরি পর ঠালা তারপর হাতিদাদা আর তার পিঠো আমি আমাদের ডাইনে একটা ঘোড়ার গাড়ি, বাঁয়ে একটা ট্রাম, পেছনে একটা টেম্পো, তার পেছনে একটা দোতালা বাস৷
উরিবাস, এই নাকি কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম৷
জ্যাম ছাড়াতেই দেড় ঘন্টা৷ তারপর অতি কষ্টে পুজো প্যান্ডেলেরে কাছে তো পৌঁছেছি ৷ কিন্তু প্যান্ডেলের কাছাকাছি রাস্তার মোড়ে ভলান্টিয়াবরা পথ আটকে দাঁড়িয়েছে৷ হাত নেড়ে তারা আমাকে বলছে, নেমে আসুন দাদা, নেমে আসুন, হাতি নিয়ে ভেতরে ঢোকা চলবে না৷
কিন্তু হাতির পিঠ থেকে নামব কী, নামলেই যে ধরা পড়ে যাব৷ আমি তো আর মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটতে পারব না৷ তবে কী করা যায়? দোড়গোড়া অবধি এসে ঠাকুর দর্শন না করেই ফিরে যাব?
ভেবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না৷ বসে আছি তো বসেই আছি৷ হাতি দাদা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়ে আছে৷ তবে হাতিদাদার আর কি – রাস্তার ধারে যত রাজ্যের ডাবেক খোলা পড়ে আছে, একটার পর একটা তুলে নিয়ে মুখে পুরছে৷
এদিকে আবার লোকেরা ঠাকুর দেখতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে হাতি দেখবার জন্যে৷ হ্যাঁ করে হাতি দেখছে হ্যাংলার মতন৷ ভলান্টিয়ারাও তাড়া লাগচ্ছে, “দাঁড়াবেন না – দয়া করে দাঁড়াবেন না – এগিয়ে যান এগিয়ে যান-
সঙ্গে হেয়ে এসেছে৷ আমার গলা সুড়সুড় করছে৷ ভীষণ ডাকতে ইচ্ছে করছে৷ ডাকব না কি, অ্যাঁ৷
আর থাকতে না পেরে তো ডেকে ফেলেছি কেয়া হুয়া হুয়া করে৷ সঙ্গে সঙ্গে আর এক কান্ডকারখানা – সবাই হইহই করে তেড়ে এসেছে আমাদের দিকে৷
আরে, শেয়াল যে রে হাতির পিঠে শেয়াল ডাকছে৷
ধর ধর টেনে নামা৷ কী অলুক্ষণে কান্ড রে বাবা৷
দে, কুকুর লেলিয়ে দে –
ততক্ষণে আমার ডাক বন্ধ হয়ে গেছে৷ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি৷ মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছি- হে মা দুগ্গা; হে মা জগদম্বা রক্ষে করো, বনের পণ্ডিত বনে ফিরে যাই৷
এমন সময় কে কে একজন ভিড় ঠেলে সামন এগিয়ে এসে বলে, “ও রে, শেয়াল নয় রে, ও একজন হরবোলা- শেয়াল ডেকে শোনাচ্ছে৷ ওরা সবরকম ডাকতে পারে৷ এই তো ওদের ব্যবসা৷
ব্যস, আর এক মজা তখন৷
মাছির মতন সব ছেঁকে ধরে ভ্যানভ্যান করতে থাকে- ও হরবোলা, পাখির ডাক শোনাও .. ও হরবোলা গাধার ডাক শোনাও ..
পুজো প্যান্ডেলের একজন বড়ো পাণ্ডা তখন ছুটে এসে বাধা দেয়< “না এখানে ওসব চলবে না এখন ৷ বড্ড গোলমাল হচ্ছে৷ রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ হরবোলা, তুমি এখন যাও৷ পুজোর পর আমাদের ফ্যাংশন হবে, তখন এসো যত খুশি ডাক শুনিয়ে যেও৷
আর আমি দাঁড়াই সেখানে? হাতিদাদার কান ধরে দিয়েছি এক টান৷ হাতিদাদাও অমনি থপ থপ করে চলতে শুরু করেছে৷
তারপর আর কী, বনের জানোয়ার কোনো গতিতে বনে ফিরে এসেছি৷
ঠাকুর দেখার যা ঠ্যালা৷
0 comments:
Post a Comment