অতল-পুরী (চীন)
চীন দেশে বাড়ী, নাম তার ফুয়াং চ্যাং। বাপমায়ের সঙ্গে চ্যাং থাকে। ছোট্ট তাদের কুঁড়ে ঘরে—শহরের ঠিক মাঝখানে চ্যাঙের বাপ হলো দোকানদার মানুষ, দোকানে নানা রকমের সুন্দর সুন্দর জিনিষ বিক্রি হয়—কাগজের মানুষ, সিল্কের পাখা, তালপাতার মানুষ, রংচঙে কাপড়, আরও কত কি।
ছোট্ট চ্যাং তার লম্বা টিকিটি পিঠে ঝুলিয়ে রোজ বই বগলে করে পাঠশালায় যায় লেখাপড়া করতে। লেখাপড়ায় তার ভারী মন। গুরুমশাই পর্যন্ত তার তারিফ করেন, সে লেখাপড়া তো ভালই করে তার ওপর আবার চমতকার চমতকার সব মিষ্টি কবিতাও লেখে।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
চ্যাং বড় হয়ে পাঠশালা ছেড়ে বাপের দোকানে দোকানদারী করতে গেল। কিন্তু দোকানদারীর কাজটা তার মোটেই ভাল লাগলো না। তার মনে হলো সারা দুনিয়াটা ঘুরে দেখতে। বাপকে জানালে মনের কথা। বাপ বললে ‘উঁহু’। মা বললে, ‘তাও কি হয় কখনো? তুই বাছা আমাদের চোখের মণি একমাত্তর ছেলে, কোথায় যাবি বাপ আমাদের ফেলে?’
চ্যাং বুদ্ধিমান ছেলে। ব’লে ক’য়ে বুঝিয়ে সমঝিয়ে কোনও রকমে মা-বাপকে রাজি করালে, তারপর বুকভরা আনন্দ আর উতসাহ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো বাড়ী থেকে।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
অনেক অনেক গ্রাম ছাড়িয়ে, শহর পেরিয়ে, পৌঁছুলো এসে শেষকালে এক সুমুদ্দুরের ধারে—বন্দরে। সেখানে অগন্তি জাহাজের মেলা, নীল সাগরে ঢেউয়ের খেলা, চ্যাং দেখে শুনে চেপে বসলো এক জাহাজে। তখন তার মনে কি ফূর্ত্তি। এইবার সে কতো মজার দেশ দেখবে—যাবে এ নগরে, সে বন্দরে। তারপর অনেক-দিন বাদে মুক্তোমণি আর সোনামোহরে থলি ভর্ত্তি করে নিয়ে ফিরবে বাড়ী।
জাহাজ দিলে ছেড়ে। জলের ঢেউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে ভেসে চললো চ্যাঙ।
অনেকদিন চলার পরে এক দ্বীপের কাছ-বরাবর এসে ওদের জাহাজ ঠেকলো জলের তলার পাহাড়ে।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
চ্যাং দেখে দ্বীপের ঘরবাড়ীর চূড়োগুলো যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। এমন সময়ে হঠাত আকাশের চারধার কালো করে উঠলো এক বিষম ঝড়। দেখতে দেখতে সমুদ্দুর উঠলো ক্ষেপে। জাহাজখানা ঢেউয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করলে কিন্তু যা হবার তাই হলো, ডুবো-পাহাড়ে ধাক্কা লেকে—চোট খেয়ে তার তলা গেল ফেটে। হু-হু শব্দে জল ঢুকে জাহাজখানাকে ডুবিয়ে দিলে। মাঝিমাল্লা কে যে কোথায় গেলো কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না। চ্যাং জাহাজের একখানা ভাঙ্গা তক্তা ধরে কোনো রকমে মরতে মরতে ঠেক্লো গিয়ে চড়ায়—কিন্তু উঠতে পারলে না, অমন ঢেউয়ে সাঁতরে নোনা জল খেয়ে বেজায় কাবু—কাজেই চড়ায় পৌঁছলো যখন তখন সে বেঁহুস্--একদম জ্ঞান নেই।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
পরদিন ভোরবেলা গোলমাল শুনে চ্যাং চোখ চেয়ে দেখে চারধারে তার ঘোড়-সওয়ার। গায়ে তাদের রংবেরঙের জামাকাপড় কুর্ত্তি—কোমরে ঝক্ঝকে তলোয়ার। ঘোড়সওয়ারদের সর্দ্দার যে, সে হলো সেই দেশের রাজপুত্তুর—লহরলাল। তাঁর কাঁচা বয়স, ফুটফুটে চেহারা, হীরেপান্নায় পোষাকপাগড়ী ঝলমল। রাজপুত্তুর হেসে চ্যাংকে শুধুলে ‘অচিন পথিক, তুমি আস্ছো কোত্থেকে ভাই? কোথায় তোমার দেশ?’
চ্যাং ফুট্ফুটে ছেলেটিকে দেখে আর তার মনভোলানোর মিষ্টি কথা শুনে তবু বুকে একটু ভরসা পেলে। রাজপুত্তুরকে নিজের পরিচয় দিলে, আর কি করে যে সে এখানে এসে পড়লে সে সব কথাও বললে খুলে।
চ্যাঙের বিপদের কথা শুনে লহরলালেল ভারি কষ্ট হলো, বল্লে—‘আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে। তুমি চীনদেশের লোক। ওঃ সে দেশের আমি ঢের গল্প শুনেছি, কিন্তু ভাই কখনো দেখিনি তো সে দেশ। তা বেশ। তোমার কাছ থেকে চীনদেশের আরও অনেক গল্প আমি শুনতে পাবো।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
এখন চলো আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ী, বাবা ভারি খুশি হবেন তোমাকে দেখলে’। এই বলে রাজপুত্তুর চ্যাংকে তার ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে ঘোড়ার লাগামে লাগালেন টান—ঘোড়া ছুটে চললো সুমুদ্দুরের ধার দিয়ে—সঙ্গে সঙ্গে সেই সব সওয়ারও ছুটলো টগ্বগিয়ে। ওমা। খানিকদূর গিয়ে ঘোড়াগুলো সব সমুদ্দুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চ্যাং গোড়াতে একটু ভয় পেলে, কিন্তু তারপরই দেখলে সে, আর এক অবাক কাণ্ড, সুমুদ্দুরের জল দুধারে ফাঁক হয়ে গেছে, আর তার মাঝখানে দিব্যি মস্ত পাঁচিল ঘেরা খট্খটে এক রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে ঠায় কদমে চললো তাদের ঘোড়া। কিছুক্ষণ পরে ঘোড়া এসে থামলো সুন্দর এক বাগানে। বাগিচার চারধারে অগন্তি ফুলের হাসি—লাল নীল নানান রঙের ফুলে বাগান আলো, প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে কত রকমের। সোনালী, সবুজ, সাদা, কালো—খানিকটা এগিয়েই মস্ত রাজপ্রাসাদ, মণি মুক্তোয় গড়া দেওয়াল তার আর ছাদটা মাছের চক্চকে আঁশের তৈরী, সামনেই সোনার সিঁড়ি।
চ্যাংকে নিয়ে রাজপুত্তুর সেখানেই নামলো—বললে, ‘তুমি বোধ হয় জান না কোথায় এলে?
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
এ হচ্ছে সাগররাজার বাড়ী, আর অমি হচ্ছি সেই রাজ্যের রাজপুত্তুর লহর। আমার বাবা রাজসভায় আছেন, চলো সেখানে’—এই বলে সোনার সিঁড়ি বেয়ে রাজপুত্তুর আর চ্যাং ঢুকলো গিয়ে ভারী সুন্দর এক ফটিকের ঘরে। সে ঘর থেকে আর এক ঘর, সেখানে থেকে আবার আর একটি। এমনি করে সাত সাতটা ঘর পেরিয়ে হাজির হলো রাজসভায়। --রাজসভা গম্গম্।
সেখানে বসে আছেন বুড়ো রাজামশাই, জমকালো রাজসিংহাসনে। বয়সে বুড়ো হলেও ভারী সুন্দর দেখতে। চ্যাং রাজাকে দেখে প্রথমটা একটু ঘাবড়িয়ে গেলো,--এর আগে সে কখনো রাজারাজড়া দেখেনি কিনা তাই। কিন্তু চ্যাং তো আর হাবা ছেলে নয়। সে একটু সামলে নিয়ে সসম্ভ্রমে রাজাকে সেলাম জানালে। রাজা রাজপুত্তুরের কাছে তার পরিচয় শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘চীনদেশের লোকেরা শুনেছি কবিতা তৈরী করতে পারে। তুমি পারে কি তেমন?’
চ্যাং বললে, ‘পারি বই কি মহারাজ’।
রাজা বললেন – ‘বেশ—আমার রাজবাড়ী নিয়ে একটি কবিতা তৈরী করো তো’।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
খুশি হয়ে চ্যাং তখন-তখনি মুখে মুখে একটি কবিতা বানিয়ে আউড়ে দিলে –
সাগরতলে মুক্তো মাণিক
হেথায় হেথায় জ্বলে,
রাজার প্রাসাদ যাদুর গড়া
ঢেউয়ের বুকের তলে।
রাজার বাগান, সবুজপরী,
ভরা ফুলের হাসি
চীনের দেশের অচিন পথিক,
আজকে অতলবাসী।
রাজা কবিতা শুনে মহাখুশি। সিংহাসন থেকে নেমে এসে আদর করে চ্যাংকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভারি চমৎকার তোমার কবিতা, তোমাকে আর ছাড়ছি না বাবা, থাকো এই সাগর রাজ্যিতে—যেয়োনা আর কোথাও। তোমাকে আমি একটা সুন্দর বাড়ী দিচ্ছি—হলুদ নদীর ধারে—মনের মতন জায়গায়। হাজার রকম ফুল রোজ সেখানে ফোটে, সোনালি রামধনু সেখানে সোনালী আলো ছড়ায়, আর সকালসন্ধ্যে গান গায় অগন্তি গাইয়ে পাখী সেখানে থাকবে দিব্যি আরামে—হাজার হাজার দাসদাসী থাকবে তোমার সেবা করবার জন্যে, তুমি হলে আজ থেকে রাজকবি।
চ্যাং ও মহাখুশি হয়ে রাজার কথায় হয়ে গেলো রাজী।
চ্যাং এখন রাজকবি—চীনদেশের দোকানদার আর নয়। থাকে মস্ত বাড়ীতে। সকাল বিকেল বুল্বুলি, শ্যামা আর ময়না পাখীর গান শোনে। ফুলের গন্ধে মন তার সব সময়েই মাতোয়ারা। সে কবিতা লেখে আর যখন তখন ঘোড়া ছুটিয়ে টগ্বগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে থাকে বিশ জন ঘোড়সওয়ার সামনে চলে দশজন ঝক্ঝকে বর্শা উচিয়ে, আর পেছনে চলে দশজন ভেরী ফুঁকতে ফুঁকতে।
বছরের পর বছর এমনি করে যতো দিন যায় পেরিয়ে, চ্যাঙের ওপর রাজার ভালবাসা ততোই ওঠে বেড়ে—শেষকালে রাজা তার আদরের মেয়েটির সঙ্গে চ্যাঙের দিয়ে দিলেন বিয়ে।
রাজার মেয়ে সাগরী দেখতে ভারী সুন্দরী। স্বভাবটিও তার ভারি মিষ্টি খুব নরম।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
তাকে পেয়ে চ্যাং সত্যি সত্যি খুব সুখী হলো।
কিছুদিন পরে তাদের হলো দুটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে। বুড়োরাজা তাঁর আদরের নাতি-নাত্নীর জন্যে নানান রকম রঙীন খেলনা কিনে দিলেন। ছোট্ট ছেলে বরুণ, আর ফুট্ফুটে মেয়ে উম্মি কখনো ফুলের বনে বেড়ায় খেলে, নেচে বেড়ায় হাওয়ার সঙ্গে,--কখনো সাগরে নেমে ঢেউয়ের দোলায় দোল খায় আর মনের আনন্দে গান গায়। চ্যাং আর সাগরীর বুকে আনন্দ ধরে না।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, হঠা একদিন চ্যাঙের খেয়াল হলো—তাই তো বাড়ীর কথা সে যে একদম ভুলে গেছে।
বাপ মা কতই না বুড়ো হয়েছেন—তার জন্যে কতই না ভাবছেন না। এখানে আর থাকা হবে না। রাজকন্যে সাগরীকে চ্যাং বললে ‘দেখ আমি অনেকদিন বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছি—আমার মাবাপের কথা মনে পড়লো—আমার দেশে ফিরে যেতে হবেই তাদের দেখ্তে।
চলো তুমি, আমি, উর্ম্মি আর বরুণ চারজনেই যাই চীনদেশে আমরা বাড়ীতে’।
সাগরী বললে, ‘সে কি করে হবে। আমরা সাগরতলের লোক। এ রাজ্যি ছেড়ে তো আমাদের যাবার যো নেই—এরাজ্যি ছাড়লেই তোমাদের মাটির ছোঁয়া লাগলে যে মরে যাব তখুনি। যদি যেতেই হয় একান্ত, তুমি একলা যাও।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
তুমি গেলে যদিও খুব কষ্ট হবে আমার। তবু ইচ্ছে হয়েছে তোমার বাপমাকে দেখতে, তখন তোমাকে ধরে রাখবো না—বাপমাকে দেখে শীগ্গির শীগ্গির চলে এসো কিন্তু’।
চ্যাং বললে—নিশ্চয়ই সে ফিরে আসবে যত শীগ্গির পারে।
সাগরী তখন চ্যাংকে একটা আয়না দিয়ে বললে—আয়না খুললেই দেখতে পাবে—আমি কি করছি কেমন আছি সব। আর তাছাড়া চ্যাঙের হাতে একথলি মোহর দিলে, শ্বশুর শাশুড়ীকে দেবার জন্যে।
তারপর সে ছেলেমেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়ে রথে করে চ্যাংকে আগের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে সমুদ্দুরের ধারে সেই চড়ায় পৌঁছে দিলে। বাপের জন্যে বরুণ আর উর্ম্মিরসে কি কান্না। বরুণ কাঁদে—‘বাবা তোমার সঙ্গে যাবো’ উর্ম্মি কাঁদে—‘বাবা তুমি যাবে না’। সাগরী নিজের চোখের জল মুছে কোনও রকমে ছেলে মেয়েদের বুঝিয়ে সুজিয়ে চ্যাংকে বিদায় দিয়ে তাদের নিয়ে ফিরলো নিজের প্রাসাদে। সমুদ্দুরের রাস্তা সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, চ্যাং কিছুই বুঝতে পারলেনা—সমুদ্দুরের বুকে নেচে উঠলো হাজার হাজার ঢেউ।
সামনেই দূরে একখানা জাহাজ দেখ্তে পেয়ে—তাতেই গিয়ে বস্লো চ্যাং।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
মাসকতক বাদে সে এসে পৌঁছুলো চীনদেশে নিজের বাড়ীতে। দেখে – তার বাপমা ভারি গরীব আর বুড়ো হয়ে গেছেন। চ্যাংকে কাছে পেয়ে বুড়োবুড়ি আনন্দে কেঁদে আকুল। চ্যাং জিজ্ঞেস করলে,--তাদের এ অবস্থা হলো কি করে?’ চ্যাঙের বাপ মা কপাল চাপড়ে বললে, ‘আগুন দেবতা তাদের সব গিলেছে। পেটে তাদের আজ ভাত নেই দুদিন’।
বুড়ো বাপমার দুঃখের কথা শুনে চ্যাঙের ভারি দুঃখ হলো তাদের কোনো রকমে সান্ত্বনা দিয়ে সঙ্গে যে সব ভালো খাবার এনেছিল তাই দিলে খেতে। বাপমা দুদিনের উপোসের পর এমন খাবার খেয়ে আর তাদের বুকের মাণিক চ্যাংকে কাছে পেয়ে ভগবানকে হাজার হাজার ধন্যবাদ দিলে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে চ্যাং বললে তার পথের বিপদের কথা, এতদিনের সব গল্প। সব শেষে সাগরীর দেওয়া মোহরের থলিটা দিলে বুড়ো বাপমাকে। বুড়োবুড়ী টাকা পেয়ে ভারি খুশি হলো এতে তাদের বাকী দিনগুলো রাজার হালে কাটবে। তারা তাদের ছেলের বৌ সাগর রাজ্যের রাজকন্যেকে আশীর্ব্বাদ করলে দুহাত তুলে।
বুড়োবুড়ী দিব্যি আরামে আছে, চ্যাং তদের মস্ত এক বাড়ী কিনে দিয়েছে চীনদেশের সব চেয়ে সেরা জায়গায়। চ্যাং কিন্তু রাজকুমারীর কথা একটি দিনের জন্যেও ভোলেনি—রোজ সাগরীর দেওয়া আয়নাতে দেখে, সাগরী হাসছে—চ্যাংও হাসে।
মাসকতক কেটে গেলে—আয়নার সাগরীর ছবি ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠলো। চ্যাঙের মনও হয়ে উঠলো উতলা।
বাপমা প্রথমটা চ্যাংকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে চাননা। শেষটায় সাগর রাজ্যে যে তাদের ছেলের বউ আর নাতিনাত্নী আছে এই কথা ভেবে বুড়োবুড়ী চ্যাংকে আশীর্ব্বাদ করে বিদায় দিলে।
চ্যাং আবার আগের সেই বন্দরে এসে জাহাজে চড়লো।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
জাহাজ চললো কত হাজার হাজার দ্বীপ ছাড়িয়ে অগন্তি শহর পেরিয়ে—কিন্তু সেই যে সেই দ্বীপ, সে দ্বীপের সীমানা চ্যাং কিছুতেই ঠাউরাতে পারলে না। মহাবিপদ ওদিকে প্রায় একবছর কেটে গেলো,--আয়নাতে চ্যাং দেখে সাগরী খালি কাঁদছে—দুচোখ বেয়ে তার মুক্তোর মতো টস্টস্ করে জল পড়্ছে। চ্যাং হতাশ হয়ে পড়লো।
শেষ কালে হঠাৎ একদিন, চারধারে রোদ ঝিক্মিক্ করছে—ভোরের বেলা চ্যাং জাহাজের ধারে দাঁড়িয়ে সূর্য্যি মামার আলোর খেলা দেখতে। হঠাৎ তার নজর পড়লো সমুদ্দুরের জলে, দেখলে দুটি সুন্দর ছোট ছেলে মেয়ে জাহাজের ধারে ঢেউয়ের ওপর ভারি মজার খেলা খেলছে—এ ওর গায়ে জল ছিটুচ্ছে ও এর গায়ে জল ছিটুচ্ছে। চ্যাং ভাল করে দেখে চিনতে পারলে—এ তারই ছেলেমেয়ে বরুণ আর উর্ম্মি। চ্যাং চিনতে পেরে হাত নেড়ে তাদের ডাক্লে। তারা বললে—‘না বাবা, মা বারণ করেছে জল ছেড়ে উঠতে। জল ছেড়ে উঠলেই নাকি আমরা মরে যাবে,-- আমরা এসেছি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে।
চ্যাঙের মনে আশা ভরসা ফিরে এলো—কাউকে কোন কথা না বলে মাঝি-মাল্লাদের হুকুম করলে জাহাজের সব পাল তুলে দিতে। জাহাজের হাল চ্যাং এবার নিজেই ধরলে।
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩
কেন না বরুণ আর উর্ম্মির পেছনে পেছনে চলতে হবে তো? দেখতে দেখতে জাহাজ এসে পৌঁছালো সেই জন-মনিষ্যি হীন দ্বীপে—চ্যাংকে নামিয়ে দিয়ে জাহাজ ফিরে চললো সেই চীনদেশে। যখন দ্বীপ থেকে আর জাহাজ দেখা গেলো না—চলে গেল অনেক দূরে—তখন বরুণ আর উর্ম্মি ঢেউয়ের তালে আবার ভেসে উঠলো হাততালি দিয়ে তাদের আদরের বাবাকে পেয়ে। তারপর সেই সমুদ্দুরের পথে রাজপুত্তুর লহর নিজেই এসে হাজির হলো চ্যাংকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যেতে। রাজপুরীতে চ্যাং রথে চেপে হাজির হলো—সাগরী তাকে পেয়ে হলো খুশি বুড়ো রাজা আহ্লাদে আটখানা—চ্যাংকে ফিরে পেয়ে রাজা ভোজ দিলেন খুব জবর। পোলাও, কালিয়া হাঁড়ি হাঁড়ি রান্না হলো বাজনা-বাদ্যিতে রাজ্যি তোলপাড়। চীনদেশের চ্যাংকে রাজা দিলেন রাজত্ব—আর অর্দ্ধেক পেলে চ্যাঙের বন্ধু—রাজকুমার লহর।
0 comments:
Post a Comment