Thursday 7 June 2018

অতল-পুরী (চীন)

অতল-পুরী (চীন)

চীন দেশে বাড়ী, নাম তার ফুয়াং চ্যাং। বাপমায়ের সঙ্গে চ্যাং থাকে। ছোট্ট তাদের কুঁড়ে ঘরে—শহরের ঠিক মাঝখানে চ্যাঙের বাপ হলো দোকানদার মানুষ, দোকানে নানা রকমের সুন্দর সুন্দর জিনিষ বিক্রি হয়—কাগজের মানুষ, সিল্কের পাখা, তালপাতার মানুষ, রংচঙে কাপড়, আরও কত কি। ছোট্ট চ্যাং তার লম্বা টিকিটি পিঠে ঝুলিয়ে রোজ বই বগলে করে পাঠশালায় যায় লেখাপড়া করতে। লেখাপড়ায় তার ভারী মন। গুরুমশাই পর্যন্ত তার তারিফ করেন, সে লেখাপড়া তো ভালই করে তার ওপর আবার চমতকার চমতকার সব মিষ্টি কবিতাও লেখে। 
⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩

চ্যাং বড় হয়ে পাঠশালা ছেড়ে বাপের দোকানে দোকানদারী করতে গেল। কিন্তু দোকানদারীর কাজটা তার মোটেই ভাল লাগলো না। তার মনে হলো সারা দুনিয়াটা ঘুরে দেখতে। বাপকে জানালে মনের কথা। বাপ বললে ‘উঁহু’। মা বললে, ‘তাও কি হয় কখনো? তুই বাছা আমাদের চোখের মণি একমাত্তর ছেলে, কোথায় যাবি বাপ আমাদের ফেলে?’ চ্যাং বুদ্ধিমান ছেলে। ব’লে ক’য়ে বুঝিয়ে সমঝিয়ে কোনও রকমে মা-বাপকে রাজি করালে, তারপর বুকভরা আনন্দ আর উতসাহ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো বাড়ী থেকে। 

⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩⏩

Thursday 22 December 2016

লালবর্ণ শিয়াল

লালবর্ণ শিয়াল




একটা ল্যাজ ঝুলছে৷ মস্ত লম্বা৷
কার ল্যাজ রে ওটা?
যারই হোক, আমার তাতে কী? ল্যাজটা ধরে একটু দোল খেয়ে নিলে বেশ মজা হয় কিন্তু৷
এই না ভেবে যেই ল্যাজটা ধরতে গেছি< অমনি হঠাত কে যেন রং ছিটিয়ে দিয়েছে আমার গায়ে৷
"আজ দোল, তাই রং দিলুম তোমার গায়ে৷ কেমন মজা? কেমন মজা? মুখপোড়া সেই হনুমানটা মুখ বাড়ায় ডালপালার আড়াল থেকে৷
"ও হরি! এ তবে তোমার কীর্তি? দাঁড়াও - দেখাচ্ছি মজা - নামো না একবার গাছ থেকে?
নামতে আমার বয়েই গেছে৷ পারো যদি তুমিই না হয় গাছে উঠে পড়ো৷' এই হনুমানটা মগডালে উঠে বসে৷
কী আর করি, মানে মানে সরে পরি সেখান থেকে৷
বনের পথে বাঘুর সঙ্গে দেখা৷
আমাকে দেখেই তো বাঘুটা হঠাত ও বাবা গো, ওটা কে গো' বলেই পিছন ফিরে দিলে এক রামছুট৷ তারপর হাতুর সঙ্গে দেখা৷ সেও আমাকে দেখে ভয় পেয়ে ছুটে পালায়৷
ভারী গোলমেলে কান্ডকারখানা৷
কেয়া হুয়া কে জানে৷
ভাবতে ভাবতে আমি তখন একটা উঁচু ডিবির ওপর উঠে পরি৷ উঠে কেয়া হুয়া রে কেয়া হুয়া বলে আওয়াজ ছাড়তে থাকি৷
হাঁকডাকে সব জড়ো হোক আগে, তারপর দেখা যাক - কোথাকার জল কোথায় গড়ায়৷ 
খানিক পরে দেখি কী, হাতিদাদার পিঠে চেপে বনের রাজাবাবু, মানে বাঘমামা আসছে৷ আর তার পেছনে আসছে বনের ছোটো -বড়ো যত জানোয়ার৷
এসেই বাঘ-রাজা গুরুগম্ভীর গলায় বলে ওঠেন, হালুম৷ হয়৷ তুমি ঠিক কোন দেশি জানোয়ার তা তো ঠিক মালুম হোতো নেই৷ তবে পাসপোর্ট বা ভিসা যদি থাকে তো দেখাও৷ নইলে আমার বিনা হুকুমে এই বনে ঢোকার জন্য বন্দি করা হবে তোমাকে৷

জয়নগরের মোয়া

জয়নগরের মোয়া





ভগাছের ডালে একটা মুখপোড়া হনুমান ৷ হনুমানটার লম্বা ল্যাজ৷ বাঘু তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছড়া কাটছে -


"এই হনুমান কলা খাবি
জয় জয়ন্নাথ দেখতে যাবি?"

ভেঙচি কেটে হনুমানটা বলছে পেলে অবিশ্যি খাই৷ কিন্তু বলি, এটা কি কলা খাবার সময়৷
রোদে পিঠ দিয়ে আমি তখন আরাম করছি৷ ফস করে বলে  ফেলি, "এটা হল ফুলকপির শিঙাড়া, নলের গুড়ের সন্দেশ আর জয়নগরের মোয়া খাবার সময়৷'
"বুড়ো বয়সে তোমার খুব যে নোলা হযেছে দেখছি৷ কিন্তু বলো দিকি, কো—থায় গেলে জয়নগরের মোয়া মেলে?" এই বলে হনুমানটা গাছের ডালে দোল খায়- যেন সার্কাস পার্টির খেলা দেখাচ্ছে৷
উত্তরটা কী হবে ভাবছি, বাঘুটা তার আগেই হাঁদার মতন বলে ওঠে, "কোথায় আবার মেলে, জয়বাংলা গেলেই মিলতে পারে৷'
ভুগোলে বাঘু বরাবরই কাঁচা৷ ওকে শুধুরে দিতে বলি, জয়রামটি জয়নগরের মোয়ার জন্য বিখ্যাত, তাও জানিসনে হাঁদারাম৷
হনুমানটা তখন জয় রাম জয় রাম বলে দু'বার চেঁচিয়ে কিচির-মিচির কিচমিচ আর হুপহাপ করে খানিকটা হেসেটেসে নিয়ে বলে, যেমন গুরু তেমনি চ্যালা কেউ কিছুটি জানে না৷ আরে বাপু, জয়নগরের মোয়া জয়নগরেই মেলে৷ ট্রেনে মিলবে শেয়ালদা গেলে৷ জয়নগর আমার মামার বাড়ি- মোয়া খাব একটি হাঁড়ি৷ সোঁদরবনের বৃক্ষ ছাড়ি - এই চললু তাড়াতাড়ি৷'
বলতে না বলতেই হনুমানটা হুপ করে দিয়েছে এক লাফ, আর শ্রীমান বাঘুও অমনি তিড়িং লাফে তার ল্যাজটা বাগিয়ে ধরে সঙ্গে সঙ্গে ঝুলে পড়েছে৷
কী দস্যি রে বাবা৷
ভয় পেযে আমি চেঁচামেছি জুড়ে দিই< "করিস কী - করিস কী ছেড়ে দে - হনুমানের ল্যাজ ধরতে নেই - মহাপাপ হবে৷
হনুমানটা ততক্ষণে লাফ দিয়ে আর একটা গাছের ডালে বসেছে৷ বাঘু দিব্যি ঝুলে আছে তার ল্যাজ ধরে৷ বলছে, "আমি যাচ্ছি জয়নগরে - হনুমানজির মামার বাড়িতে৷ জয়নগরের মোয়া না খেয়ে ফিরছি না৷
বাঘুর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাত একটা আওয়াজ শোনা যায়৷ বাপ রে, সে কী আওয়াজ৷ আমার পিলে-টিলে সব চমকে  ওঠে৷ বাঘু হনুমানের ল্যাজ ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে মাটিতে এসে পড়ে৷ হনুমানটা "জয় রাম' বলে চেঁচিয়ে ওঠে৷
আমি আকাশের দিকে তাকাই৷ বাঘুর গায়ের ধুলো-টুলো ঝেড়ে আকাশমুখো হয়৷ 
একটা হেলিকাপ্টার
খুব নীচু দিয়ে সেটা উড়ে যাচ্ছে৷

কচ্ছপের কামড়ে

কচ্ছপের কামড়ে




ভাগ্যিসি সেদিন আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠেছিল, না হলে কি আর সেই বিদঘুটে নাড়োড়বান্দা জীবটা ছাড়ত আমাকে?
গরমে আইচাই করতে করতে নদীর জলে নেমেছি - মুখ ডুবিয়ে চুকচুক করে সবে জল খেতে শুরু করেছি - এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই, কে যেন আমার ল্যাডটা আচ্ছা করে কামড়ে ধরেছে৷
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি কি-
ওরে বাবা- প্রকান্ড একটা কচ্ছপ যে৷
"ছাড় বাবা, ছেড়ে দে বাবা' বলে যতই খোশামোদ করি কচ্ছপটা ততই আমাকে পেয়ে বসে৷ কথায় বলে কচ্ফপের কামড় ছাড়তে কি আর চায়?
কচ্ছপটা আবার অসম্ভব ভারী৷ কোনো গতিকে সেটাকে টানতে টানতে আর চেঁচাচে চেঁচাচে বাসার দিকে পা চালাই- ওরে বাঘু রে, ওরে হাতু রে, কে কোথায় আছিস রে, শিগগিরি আয় রে-৷
 এই করে তো অতি কষ্টে বাসার কাছ বরাবর গেছি< আর বাঘুরাও হই-হই রই-রই করে এসে পড়েছে৷
আমরা ল্যাজে মস্ত একটা কচ্ছপকে ঝুলতে দেখে ওরা ধেই-ধেই করে নাচ জুড়ে দিয়েছে-
"ওরে কী মজা রে'
"শ্যালপঞ্জিত ল্যাজে করে কচ্ছপ ধরে এনেছে রে৷
"আজ আমাদের জোর ফিস্টি হবে রে৷'
ওদের নাচ আর থামে না৷
এদিকে কচ্ছপটাও আমার ল্যাজ ছাড়ে না৷
যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বলি, "বাবা রে, আমার ল্যাজ গেল- শিগগির ছাড়া আগে৷' কিন্তু ছাড়াবেই বা কী করে?
টানাটানি করে ছাড়াতে গেলে যদি ল্যাজটাই কেটে নেয়?
বাঘুদের নাচ থেমেছে৷ ওরাও তখন ভাবছে কী করা যায় - কী করে ল্যাজ ছাড়ানো যায়৷
এমন সময় আকাশে গুড়গুড় গুড়গুড় করে মেঘ ডাকে৷ মেঘ ডাকতেই কচ্ছপটা আমার ল্যাজ ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়৷
বাঘরা আনন্দে হাততালি দেয়৷
আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি৷
হুড়ুম-দড়ুম গুড়ুম-গুড়ুম করে মেঘেরা তখন গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে৷ দেখতে দেখতে চড়বড় চড়বড় করে বৃষ্টিও নেমেছে৷
বাঘরা নেচে নেচে ছড়া বলছে-
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
রা্শন দেব মেপে৷
মাথায় দিয়ে টোকা৷
লাইন দেবে খোকা৷৷
তারপ ক'দিন ধরে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি৷
এই বৃষ্টি তো এই বৃষ্টি৷
টিপটিপ ঝিরঝির ঝরঝর ঝমঝম-হরদম কানে আসছে বৃষ্টির ধারাপাত - সারাদিন সারারাত৷
আমার আবার সর্দির ধাত৷ ভিজে ভিজে খালি গোবার হচ্ছি আর হ্যাঁচ্ছো হ্যাঁচ্ছে করে হ্যঁচে মরছি৷
ছাতা না কী যেন বলে, তাই মাথায় দিয়ে মানুষগুলো কিন্তু দিবি্্য আছে৷ ব্যাঙেদেরও ছাতা হয়, সে ছাতা তো এই বনে জঙ্গলে বিস্তার৷
আহা, এই বর্ষার কেউ যদি একটা ছাতা দিয়ে আমার মাথাটা অন্তত বাঁচত৷
কথাটা বাঘমামার কানে তুলেছি৷ বাঘমামার বড়ো দয়ার শরীর৷ কলকাতার মাসিকে চিঠি লিখে একটা ছাতা আনিয়ে দিয়েছে৷
বাঘু সেই ছাতাটাকে আমার ঘাড়ে বেশ করে বেঁধে ঢেঁধে ফিট করে দিয়েছে৷
টিপটিপ পড়ছে ছাতার কাপড়ে৷ গায়ে এক ফোঁটা লাগছে না আর৷ ঠিক যেন হচ্ছে একটা হয়ে যাচ্ছে৷



বাঘুর কথায় কান না দিয়ে আমি গুটি গুটি অনেক দুর হেঁটে এসেছি৷ মুশকিল হয়েছে কী, ছাতায় ঢাকা পড়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না৷ আন্দাজে চলেছি৷
হঠাত কে যেন পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠেছে _ ওরে দ্যাখ, দ্যাখ, ইয়া বড়ো একটা কচ্ছপ নদী থেকে উঠে এসেছে৷
তারপর আর কী, দমাদ্দম লাঠি-সোঁটা পড়তে থাকে ছাতার ওপর৷
ছাতার ভেতর থেকে আমি যতই "বাপ রে মা রে ' করে চেঁচাচ্ছি - ওরা ততই ধর ধর মার মার করে পিটে যাচ্ছে৷ হট্টগোলে আমার কথা ওরা বোধহয় শুনতেই পাচ্ছে না৷
ছাতার শিকগুলো বেঁধে তেবড়ে-তুবড়ে গেছে, ছাতার কালো কাপড়টাও শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে খুঁড়ে ফর্দাফাঁই৷
সশরীরে মাথটা নিয়ে আমি তখন বেরিয়ে পড়েছি৷ আমাকে দেদেই ওরা যেন ভূত দেখার মতন অাঁতকে উঠেছে - ওরে৷ পন্ডিতমশাই যে রে৷ পালা - পালা - পালা৷



ঠাকুর দেখার ঠ্যালা

ঠাকুর দেখার ঠ্যালা





কলকাতা শহরে পুজোয় নাকি খুব ধূমধাম৷

বাজারের ঠাকুরহাতিবাগানের ঠাকুরদমকলের ঠাকুর নামকরা সব ঠাকুর৷ টা দিন খুব ভিড় হয়৷ মেলা বসে৷ আলোয় ভালো হয়ে চারদিক ঝলমল ঝলমল করে৷ মাইক গান বাজে৷ ঢোল বাজ৷

হাতিদাদাকে ডেকে বললুম, “মানুষের দেশে হাতি তো খুব খাতির৷ তুমি যদি আমাকে কলকাতার ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাও তো চ্যাংড়া কুকুরগুলো কী করতে পারে শুনিচলো না গোহাতিদাদালক্ষ্মীটি৷

হাতিদাদা বলেন,রাজি৷ তবে তোমার ওই খেঁকুরে মার্কা চেহারাটা ঢেকেঢুকে যেতে হবেবাপু৷ যেন কেউ চিনতে না পারে৷ আদ্দির পাঞ্জাবি গিলে করে গায়ে চাওড়াফিনফিনে ধুতি কুঁচিয়ে পরোটেকো মাথায় চাপাও জরিদার পাগড়ি চোখে দাও চশমাতারপর দিবি্ও রাজাবাবুটি হয়ে বাগিয়ে বসে পড়ো আমার পিঠের ওপর৷

হাতিদাদার বুদ্ধি ভারী খাসা৷ কত বড়ো মাথাটা বুদ্ধিতে ঠাসা একেবারে৷ যেমনটি বলেছে ঠিক তেমনিটি সেজে নিয়েছে৷ নিয়ে দুগ্গা বলে উঠে বসেছি তার পিঠে৷ কিন্তু হাতিদাদা বজ্জ আস্তে আস্তে হাঁটে৷ আর ডাইনে বাঁয়ে শুঁড় চালিয়ে মটমট করে ডালপালা ভাঙে৷

আমি তাড়া দিই  হাতিদাদাতাড়াতাড়ি চলে না গোপুজো যে ফুরিযে যাবে?

হাতিদাদা বলে, "ব্যস্ত কেনআর তো মোটে একপোয়া পথ৷ ওই শোনঢাকের বা্দ্যি কানে আসছে৷ 

তা হাতিদাদা মিথে বলেনি৷ ঢাকের বা্দ্যি সত্যিইি কানে আসছে৷ ক্রমেই যেন কাছে আরও কাছে এগিয়ে আসছে৷

এই করে তো একসময় পে্ৗঁছে গেছি কলকাতায়৷ রাত তখন ভোর হচ্ছে৷ লোকেরা গঙ্গায় চান করতে যাচ্ছে৷ কত লোক সারারাত ঠাকুর দেখে দেখে এখন হইচই করে বাড়ি ফিরছে৷

তারপর একটু বেলা হতেই তো আমার মাথা ঘুরে যায়৷

বাপ রে বাপএই নাকি কলকাতা৷

কী পেল্লায় পেল্লায় সব বাড়ি৷ কোনটা চারতলাকোনটা পাঁচতলাকোনটা সাততলা - একের পর এক আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছেআর গিজগিজ গাড়ি ঘড়ঘড় রাস্তাগুলোর তো চলা দায়ট্রামবাসটেমপোলরিরিক্সাঠেলা... কতরকম গাড়ি৷ প্যাকপ্যাক ঠংঠং ঠুংঠুং কতরকম আওয়াজ৷

এখন হাতিদাদাকে নিয়েই ভারী মুশকিল৷ এই গাড়িঘোড়ার ভিড়ে একটা মশা গলবার জায়গা নেই তো হাতি কেমন করেতা ছাড়া লোকে রাস্তায় হাতি দেখতে পেয়ে ঠাকুর দেখতেই ভুলে যাচ্ছে৷ হাতিদাদাকে ঘিরে ভিড় জমে উঠছে৷ বাচ্চাগুলোর তো খুব ফুর্তি কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে ডাবের খোলাকেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে পয়সা

এমন সময় দেখা গেল- ঢাক বাজিয়ে কারা কলাবউকে চান করিয়ে ফিরছে৷ হাতিদাদা আবার কলাগাছ খেতে বড্ড ভালোবাসে৷ লোভ সামলাতে না পেরে দিয়েছে তো শুঁড় বাড়িয়ে কলাবউকে খাবে বলে৷ পুরুতমশাইও বাবা রে মা রে বলে কলাবউকে জাপটে ধরেই দিয়েছে এক তিড়িং লাফ৷ সঙ্গে সঙ্গে সে এক হইহই ব্যাপার রইরই কান্ড৷ হাতি খেপেছে মনে করে যে যেদিকে পেরেছে ছুটেছে৷

বাস, গাড়ি_ঘোড়া বন্ধ৷ ট্রাফিক জ্যাম৷

রাস্তার পুলিশ ঘন ঘন বাঁশি বাজাচ্ছে আর ছুটোছুটি করছে৷

ট্রামের পর বাস, বাসের পর ট্যাক্সি, ট্যাক্সিরি পর ঠালা তারপর হাতিদাদা আর তার পিঠো আমি আমাদের ডাইনে একটা ঘোড়ার গাড়ি, বাঁয়ে একটা ট্রাম, পেছনে একটা টেম্পো, তার পেছনে একটা দোতালা বাস৷

উরিবাস, এই নাকি কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম৷

জ্যাম ছাড়াতেই দেড় ঘন্টা৷ তারপর অতি কষ্টে পুজো প্যান্ডেলেরে কাছে তো পৌঁছেছি ৷ কিন্তু প্যান্ডেলের কাছাকাছি রাস্তার মোড়ে ভলান্টিয়াবরা পথ আটকে দাঁড়িয়েছে৷ হাত নেড়ে তারা আমাকে বলছে, নেমে আসুন দাদা, নেমে আসুন, হাতি নিয়ে ভেতরে ঢোকা চলবে না৷

কিন্তু হাতির পিঠ থেকে নামব কী, নামলেই যে ধরা পড়ে যাব৷ আমি তো আর মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটতে পারব না৷ তবে কী করা যায়? দোড়গোড়া অবধি এসে ঠাকুর দর্শন না করেই ফিরে যাব?

ভেবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না৷ বসে আছি তো বসেই আছি৷ হাতি দাদা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়ে আছে৷ তবে হাতিদাদার আর কি – রাস্তার ধারে যত রাজ্যের ডাবেক খোলা পড়ে আছে, একটার পর একটা তুলে নিয়ে মুখে পুরছে৷

এদিকে আবার লোকেরা ঠাকুর দেখতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে হাতি দেখবার জন্যে৷ হ্যাঁ করে হাতি দেখছে হ্যাংলার মতন৷ ভলান্টিয়ারাও তাড়া লাগচ্ছে, “দাঁড়াবেন না – দয়া করে দাঁড়াবেন না – এগিয়ে যান এগিয়ে যান-

সঙ্গে হেয়ে এসেছে৷ আমার গলা সুড়সুড় করছে৷ ভীষণ ডাকতে ইচ্ছে করছে৷ ডাকব না কি, অ্যাঁ৷

আর থাকতে না পেরে তো ডেকে ফেলেছি কেয়া হুয়া হুয়া করে৷ সঙ্গে সঙ্গে আর এক কান্ডকারখানা – সবাই হইহই করে তেড়ে এসেছে আমাদের দিকে৷

আরে, শেয়াল যে রে হাতির পিঠে শেয়াল ডাকছে৷

ধর ধর টেনে নামা৷ কী অলুক্ষণে কান্ড রে বাবা৷

দে, কুকুর লেলিয়ে দে –

ততক্ষণে আমার ডাক বন্ধ হয়ে গেছে৷ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি৷ মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছি- হে মা দুগ্গা; হে মা জগদম্বা রক্ষে করো, বনের পণ্ডিত বনে ফিরে যাই৷

এমন সময় কে কে একজন ভিড় ঠেলে সামন এগিয়ে এসে বলে, “ও রে, শেয়াল নয় রে, ও একজন হরবোলা- শেয়াল ডেকে শোনাচ্ছে৷ ওরা সবরকম ডাকতে পারে৷ এই তো ওদের ব্যবসা৷

ব্যস, আর এক মজা তখন৷

মাছির মতন সব ছেঁকে ধরে ভ্যানভ্যান করতে থাকে- ও হরবোলা, পাখির ডাক শোনাও .. ও হরবোলা গাধার ডাক শোনাও ..

পুজো প্যান্ডেলের একজন বড়ো পাণ্ডা তখন ছুটে এসে বাধা দেয়< “না এখানে ওসব চলবে না এখন ৷ বড্ড গোলমাল হচ্ছে৷ রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ হরবোলা, তুমি এখন যাও৷ পুজোর পর আমাদের ফ্যাংশন হবে, তখন এসো যত খুশি ডাক শুনিয়ে যেও৷

আর আমি দাঁড়াই সেখানে? হাতিদাদার কান ধরে দিয়েছি এক টান৷ হাতিদাদাও অমনি থপ থপ করে চলতে শুরু করেছে৷

তারপর আর কী, বনের জানোয়ার কোনো গতিতে বনে ফিরে এসেছি৷

ঠাকুর দেখার যা ঠ্যালা৷